Sunday, May 1, 2022

এই রাত তোমার আমার

আমার মনে হয় একটা শহরের সৌন্দর্য তার নাইট লাইফে। আমার চোখে ঢাকা সবচেয়ে সুন্দর রাত ১২টার পরে, ভোর ৬টার আগে। ইদানীং রমজান মাসে মানুষ গভীর রাতে সেহরি করতে দলবেঁধে রেস্টুরেন্টে যায়- আমার ভালো লাগে সেটা। অনেকদিন ধরে ইচ্ছা ছিলো সেহরিতে বের হওয়ার। বছর ঘুরে সেহরি 'সুহুর' হয়ে গেল। তাও আমার যাওয়া হচ্ছিল না। অনেককে বলেছি সঙ্গে যেতে, আমার সঙ্গে 'রাতের রানী' হতে। কারো হয়ত আগ্রহ হয়নি, কারো হয়ত সুযোগ হয়নি কিংবা সময় মেলেনি। বিশেষ করে যেহেতু 'ভালো মেয়ে'রা রাতে ঘরের বাইরে বের হয় না, সেহেতু রাত বারোটার পর বের হওয়া অনেকের জন্য কঠিন। আমার সেই দীর্ঘ অপেক্ষা ফুরালো পরশু রাতে। বন্ধুদের একটা উদযাপন ছিলো। আমি রাতে থেকে গেলাম আড্ডা দিতে।


ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছিল। পুকুরপাড়ে বসেছিলাম কজন।


হু হু বাতাসে উড়ে যেতে যেতে মনে হলো এমন সুন্দর রাতে নগরভ্রমণ করা উচিত। ছেলেদের হল। গেট সারারাতই খোলা থাকে। স্মিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। স্মিতার সেদিন জন্মদিন। তাই ওর ইচ্ছাতেই ঘোরা হলো। প্রথমে গেলাম বুয়েটে। বুয়েটের গেট বন্ধ। তারপর গেলাম পলাশীতে চা খেতে। পলাশীও বন্ধ। তারপর গেলাম বুয়েটের ছাত্রীহলে। এই হল আমাদেরকে রাত দশটার পরে ঢুকতে দিত না। রাত দুইটায় এসে দর্শন দিয়ে যাওয়াটা তাই জরুরি মনে হলো।


সেখান থেকে নীলক্ষেত। দোকানপাট সব খোলা। এমনকি বালিশ তোশকের দোকানও। এত রাতে কে বালিশ কিনতে আসে কে জানে? নীলক্ষেতের মোড়ে ট্রাফিক দেখে কে বলবে তখন রাত দুইটা?

জ্যাম এড়িয়ে টিএসসিতে চলে এলাম৷ বাইক পার্ক করে চা খুঁজতে লাগলাম। এক চাওয়ালা মামা নিজে এগিয়ে এলেন। স্মিতার সাথে ওয়ালেট নেই। আর আমার ওয়ালেটে টাকা নেই। ওয়ালেট খুলে দেখি দশ টাকার কটা নোট। এক কাপ র চা দশ টাকা। দু কাপ নিলাম। সাত কি আট বছর বয়েসি একটা মেয়ে অনেকগুলো বেলি ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলাম দাম কত। বললো বিশ টাকা। জিজ্ঞেস করলাম দশ টাকায় দেবে কি না। কারণ টাকা নেই সাথে। সে তার সমবয়েসি এক ছেলের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলো এত কমে মালা বেচবে না।

আমরা ফুটপাথে উঠে চা খেতে লাগলাম। মালা হাতে মেয়েটা ঘুরে বেড়াচ্ছে তখনো। আমাদেরকে সাবধানে এড়িয়েও যাচ্ছে। স্মিতা বললো মালাগুলো একদম তরতাজা, টাকা থাকলে কিনত।

জন্মদিনে একটা মানুষের এইটুকু শখ পূরণ হবে না এটা তো হতে পারে না। তাই একটা মালা নিয়েই নিলাম। ততক্ষণে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা একটা কাঠবাদাম গাছের নিচে ঠাঁই নিলাম। সেখানে আরো কিছু ছেলে জটলা পাকিয়ে বসা। সামনে অনেকগুলো হেলমেট জড়ো করা। বুঝলাম তারাও বাইকার। তারা আমাদেরকে বসার জায়গা করে দিলো। বললো যে এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকবে না। টিএসসি মোটামুটি সরব তখনো। নারী পুরুষ সবাই আছে। ঘুরছে, আড্ডা দিচ্ছে, চা খাচ্ছে। একটা আনন্দময় পরিবেশ।

মিনিট পাঁচেক পরে বৃষ্টি ধরে এলো। আমরা ঘুরেফিরে আবার ক্যাম্পাসে চলে এলাম।



ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সুমাইয়া আপু বললো, "এখনই যাবা? পাখির ডাক শুনে যাও!" বললাম যে মানিকমিয়া এভিনিউতে নতুন সূর্য দেখতে চাই। বের হতে হতে পাখিরাও ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে অবশ্য।



মানিকমিয়া এভিনিউতে এসে ঠিক ঠিক সূর্যোদয় পেয়ে গেলাম।


সঙ্গে পেলাম একরাশ সোনালু ফুল। 



একাগ্রচিত্তে দাঁড়িয়ে ফুল দেখছিলাম। এমন সময় গেরুয়া বসনে এক বুড়ো লোক আমার পাশে দাঁড়ালেন। বললেন কিছু টাকা দিতে। আমি জানি আমার ওয়ালেট তখন গড়ের মাঠ। তাই ক্ষমা চেয়ে নিলাম। উনি চলে গেলেন। কী মনে করে ওয়ালেট খুললাম আবার। দেখি পনেরো টাকা আছে। বুড়োকে ডাক দিলাম পেছন থেকে। যা ছিলো তা-ই দিলাম। উনি হেসে বললেন, "তোমার ভালো হোক।"
উনার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় হাওয়ার দোলায় মাথার উপর থেকে সোনালু ঝরে পড়তে লাগল। 

জীবনের সৌন্দর্যে অভিভূত হৃদয় আর শূন্য পকেটে ঘরে ফিরেছি কাল। রাতটা ছিলো এক পরম উপহার।





No comments:

Post a Comment