Thursday, July 21, 2016

হীরের চাকা

কিছুদিন আগে যখন হীরের আংটির খোঁজখবর করছিলাম, তখন কারো কারো (কিংবা হয়ত অনেকের বা সবার) মনে প্রশ্ন জেগেছিলো আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি কি না। যারা আমাকে চেনেন তারা নিশ্চয়ই জানেন বিয়ে করতে আমার হীরের প্রয়োজন হবে না। আংটি আসলে খুঁজছিলাম আমার মায়ের জন্য। এর পেছনে একটা গল্প আছে। মুখে এই গল্পটা কখনোই বলে বোঝাতে পারব না। তাই অক্ষরের আশ্রয় নিচ্ছি। ব্লগ না লিখে আম্মুকে চিঠি লেখা যেত, মেইল করা যেত। কিন্তু আমি চাই আরো অনেকে জানুক এই গল্পটা। আমি নিশ্চিত এই গল্প আমার একার নয়, আরো অনেকের।

গল্পের শুরুটা কবে? দুই যুগ আগে যখন আমার ইচ্ছেপূরণের মূল্য আমার মা দিয়েছিলো তখন? নাকি চার দশক আগে, যখন আমার কিশোরী মায়ের ইচ্ছের মৃত্যু হয়েছিলো তখন?
আম্মু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, লড়ছে। ছবিটা আব্বুর তোলা।
আমার মা মফস্বল শহরের ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছয় বোন আর দুই ভাইয়ের সংসারে বেড়ে ওঠা একজন বাঙালি মেয়ে। বাড়ির সংখ্যালঘু কালো সদস্যদের একজন ছিলো বলে তার জগতে গঞ্জনার অন্ত ছিলো না, আর ডানপিটে গেছো মেয়ে ছিলো বলে ভর্ৎসনাও কম সইতে হয়নি। নানাভাইয়ের (মানে আমার মায়ের বাবার) সাইকেল লুকিয়েচুরিয়ে হাফপ্যাডেলে চালাতে গিয়ে উলটে পড়ে গা ছড়ে দিয়ে বেদম মার খেত, লুকিয়ে গান শিখতে যেয়ে ধরা পড়ে গান শেখাও বন্ধ হয়ে গেল। মেয়ে বলে তার নিজের একটা সাইকেল কখনোই হয়নি। এমন আরো না হওয়া ব্যাপারগুলো নিয়ে তৈরি প্রথাগত ফর্দটা যেন তার কন্যাসন্তানকেও বইতে না হয় তার জন্য নিজ হাতে নিজের জীবনের কাঁটাতারগুলো একে একে উপড়ে গেছে সে। চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ের ফাঁদ ডিঙিয়েছে, সবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঢাকায় পড়তে এসেছে, নিজের বৃত্তির টাকায় পড়ালেখা শেষ করেছে, নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে। হার না মানা কালো গেছো মেয়েটা আপন মনে লড়ে গেছে, গড়ে চলেছে তার অনাগত কন্যাসন্তানের জন্য জগতের আনন্দযজ্ঞের সরলতর পথ।

আমার যখন জন্ম, আমার মায়ের বয়স তখন ২৩। জন্মের পরপর বাবার কাজের সূত্রে ইরানের এক মনোরম গ্রামে থাকতে চলে যাই আমরা। হাসপাতালের সাথে লাগোয়া আমাদের ছোট্ট বাংলোকে ঘিরে কয়েক একরের বিশাল ফলফুলের বাগানে, যেখানে প্রায় বিকেলেই আড্ডা জমত, সেখানে এক আড্ডায় এক ইরানি বালকের বাইসাইকেলে আমার প্রথম হাতেখড়ি। তখন আমার বয়স সম্ভবত পাঁচ। বাইসাইকেল চালানো যখন শিখেই গেছি, এবার তো নিজের বাইসাইকেল চাই। প্রতি মাসে বেতন নিতে দল বেঁধে বড়রা ছোটদের বগলদাবা করে হৈ হৈ করে শহরে আসত। সেবার শহরে গিয়ে বাইসাইকেল দেখা শুরু হলো। 
ছবিটা ঢাকায় তোলা। আমার বয়স তখন ৮ কিংবা ৯। 
সঙ্গের সাইকেলটা সেই BMX-এর বড় সংস্করণ। 
দেশে ফেরার আগে প্রথমটা বদলে একইরকম দেখতে 
বড় সাইকেল নিয়ে এসেছিলো আম্মু, 
যাতে আরো অনেকদিন চালাতে পারি। 
অনেকদিন চালিয়েছিলামও।
অনেক অনেক বাইসাইকেলের ভিড়ে চোখ আটকে গেল একটা কালো-হলুদ BMX সাইকেলে। দাম মনে নেই। তবে দাম বাড়াবাড়ি রকমের বেশি ছিলো সেটা মনে আছে। সঙ্গে টাকা ছিলো না, নাকি খরচের খাতায় বাজেট ছিলো না সেটাও আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে আমার মা কিছুতেই সেই সাইকেল ফেলে ঘরে ফিরতে রাজি ছিলো না। সে ঠিক করল তার হাতের আংটি বেচে এই সাইকেলটা সে আমাকে কিনে দেবে। এবার আমি বেঁকে বসলাম। জানি না কেন, মায়ের প্রিয় গয়না বিক্রি করে সাইকেল কেনার ভাবনায় প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আম্মুই বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালো। আমাকে কাঁদতে দেখে আম্মু বললো বড় হয়ে অমন অনেক আংটি আমি আম্মুকে কিনে দিতে পারব, একটা আংটির জন্য নাকি এত দুঃখ পাবার কিছু নেই। তারপর পাশের এক দোকানে গিয়ে আংটি বিক্রি করা হলো। আংটিটার চেহারা স্পষ্ট মনে আছে আমার। সোনার আংটিতে উঁচু উঁচু নকশা করে ছোট ছোট হীরে বসানো। নকশাটা ভালো করে মনে রাখতে হয়েছিলো। কারণ, সেদিন সেই মুহূর্তে ছোট্ট আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বড় হয়ে আম্মুকে অবশ্যই সেই আংটিটা কিনে দেবো।

কতটা বড় হলে তাকে ঠিক বড় হওয়া বলে জানি না। তবে যেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য আমার মাকে লড়তে হয়েছে, সেই লড়াইয়ে অনেকখানিই জিতে গেছি। এই জয় অবশ্যই আমার মায়েরও। আমার সাথে সাথে আমার সাইকেলও বদলেছে, বড় হয়েছে। ইব্রাহিমাবাদের ধুলোমাখা পথ থেকে ঢাকার রাজপথে দীর্ঘ যাত্রায় বাংলাদেশের মেয়েদের সাইকেলের গল্প অনেকদূরই এগিয়েছে। শুধু বাকি ছিলো প্রতিজ্ঞা পূরণের। এই অনিশ্চিত সময়ে আর সবকিছুর আগে শৈশবের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করাটা আমার কাছে জরুরি মনে হলো।

গতবছর বিডিসাইক্লিস্টের বিজয় রাইডে কোনো এক অচেনা ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় তোলা ছবি

গয়নাগাটি যে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় সে তো সেই পাঁচ বছর বয়সেই জেনেছি। বলাবাহুল্য, হীরের আংটি নিয়ে কোনোই ধারণা আমার ছিলো না। খোঁজ নিতে বসে আবিষ্কার করলাম, ঝকমকে এই পাথরের অর্থমূল্য প্রকারভেদে এক সপ্তাহের নেপাল ট্রিপ থেকে শুরু করে এক মাসের ইউরোপ ট্রিপের সমান হতে পারে। কদিনের সঞ্চয়ে কত মূল্যে অবশেষে এই আংটি কেনা হলো সেই গল্পে আর না যাই। অর্থমূল্য এখানে নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক।

অনেক ধরেবেঁধে যেই আংটিটা আম্মুকে দিয়ে পছন্দ করাতে পারলাম সেটা দেখতে সেই আংটিটার মতো না। আমি তাকে নিয়ে গেছিলাম নিজের জন্য কিছুমিছু কিনব বলে। আমি যে আসলেই 'নিজের জন্য হীরের গয়না কিনতে চাই' সেটা বিশ্বাস করাতেও কিছুটা সময় নিয়ে সামান্য কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো। সে আদৌ জানত না সেই আংটিটার নকশা মাথায় গেঁথে বসে আছি, আর সেই আংটির স্মৃতির পথ ধরে এই আংটির পথ খোঁজার শুরু। পুরনো সেই আংটির জন্য হাহাকারও তার ছিলো না। তাই আংটি পছন্দ করার বেলায় পুরনো আংটির নকশা নিয়ে আদৌ ভাবিত ছিলো না সে। তার মেয়ে তাকে ভেবে কিছু দিয়েছে এতেই সে অতি অভিভূত। তার মেয়ে হীরে কেনার যোগ্যতা অর্জন করেছে তাতে হয়ত গর্বিতও। তার আদৌ মনে নেই আমার শৈশবের প্রতিজ্ঞার কথা, যেমনটা মনে নেই সেই আংটির শূন্যস্থান পূরণ করতে নতুন হীরের আংটি কেনার কথাও। 'এতগুলো টাকা' খরচ করে আংটি কেনায় তার ঘোর আপত্তি ছিলো। দোকানে দাঁড়িয়েই অনেকক্ষণ তার সাথে দেনদরবার করতে হয়েছে, ঠিক যেমন সাইকেলের দোকানে দাঁড়িয়ে আমাকে রাজি করতে বেগ পেতে হয়েছিলো তাকে।
হীরের দোকানে দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারিনি এই আংটির জ্যোতি আম্মুর চেহারার ছেলেমানুষি খুশি আর গর্বভরা হাসির কাছে ম্লান, শৈশবের সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারা আমার কাছে অনেক বড় কিছু।


গীতি আপা একবার বলেছিলেন, "প্রতিটা মেয়েই তার মায়ের স্বপ্ন।"
আমার মায়ের অনেক স্বপ্নই আমি পূরণ করতে পারিনি। নিজের সব স্বপ্ন যে পূরণ করতে পেরেছি তাও নয়। আমি চাই প্রতিটা মেয়ে সব কাঁটাতার পেরিয়ে মানুষ হোক, আর প্রতিটা মানুষ নিজের ইচ্ছের সমান বড় হোক, স্বপ্নের মতো উজ্জ্বল হোক তার ভবিষ্যত। সাইকেলের চাকা ঘুরে হীরের আংটির এই যাত্রা আমাদের মা-মেয়ের ইচ্ছেপূরণের পথে ছোট্ট একটা মাইলফলকমাত্র।