Pages

Saturday, September 7, 2024

বাংলাদেশে যৌনপেশার প্রশ্নোত্তর


গত বৃহস্পতিবার (২৯ অগাস্ট ২০২৪) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যেখানে যেখানে দেখা যায় একজন যুবক ঢাকার শ্যামলী এলাকার রাজপথে সবুজ রঙের একটি রড হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের লাঠিপেটা করছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে তিনি যখন যৌনকর্মী নারীদের তাড়া করছিলেন তখন ক্যামেরা তাকে অনুসরণ করছিলো। অর্থাৎ আক্রমণকারী যুবক সচেতনভাবে উদ্যোগ নিয়ে এবং ভিডিওচিত্র ধারণ করার প্রস্তুতি নিয়েই পথে নেমেছিলেন। শুধু লাঠিপেটা করে তিনি ক্ষান্ত হননি। এই ভাসমান যৌনকর্মীদের সাথে থাকা নগদ অর্থ এবং মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন তিনি। আক্রমণশেষে তিনি উপস্থিত জনতাকেও আহ্বান জানান যৌনকর্মীদের একইভাবে বিতাড়িত করতে। উপস্থিত পথচারীদের একটি অংশ তালি দিয়ে এই যুবককে সাধুবাদ জানান। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ এবং আতংকিত যৌনকর্মীরা সেক্স ওয়ার্কারস নেটওয়ার্কের আয়োজনে প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হন ঘটনার এক সপ্তাহ পরে। সেখানে আমি সংহতি প্রকাশ করতে উপস্থিত হয়েছিলাম। সংবাদ সম্মেলন চলাকালে এবং সংবাদ সম্মেলনের পর একজন নারীবাদী সংগঠক হিসেবে কিছু সাংবাদিকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর আমি দিয়েছি। আমি মনে করি প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে যৌনপেশার প্রতি জনমানসের দ্বিধাবিভক্ত অনুভূতি প্রকাশ পায়। বাংলাদেশের যৌনকর্মী এবং অধিকারকর্মীরা যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য এবং মানুষ হিসেবে যৌনকর্মীর মৌলিক মর্যাদা অর্জনের জন্য যে দীর্ঘ লড়াইয়ে নাম লিখিয়েছেন তার যৌক্তিকতা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয় যৌনপেশাকে কেন্দ্র করে মানুষের দ্বিধা, অস্বস্তি এমনকি ঘৃণা থেকে উৎসারিত এই প্রশ্নগুলো দিয়ে। তাই প্রশ্নের উত্তরগুলো নিয়ে আলোচনা হওয়াটা আমি জরুরি মনে করি। আমার প্রতি সাংবাদিকদের প্রশ্ন এবং তার উত্তরগুলো আমি এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।



প্রশ্ন ১: আজকে এখানে যৌনকর্মীরা কী চাইতে এসেছেন? 


উত্তর: আপনাদেরকে নিশ্চয়ই প্রেস ব্রিফিং দেওয়া হয়েছে। সেখানে যৌনকর্মীদের দশটি দাবি স্পষ্টভাবে লেখা আছে। আমার অনুরোধ থাকবে যেকোনো দাবি নিয়ে বিশ্লেষণ বা মত প্রকাশের আগে একজন যৌনকর্মীকে আপনার সমমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখুন। তাহলে আশা করি বুঝতে পারবেন কেন তাদেরও নিরাপত্তা ও সম্মানের অধিকার রয়েছে।


প্রশ্ন ২: আপনি এই সংবাদ সম্মেলনে কেন এসেছেন?


উত্তর: একজন নারী হিসেবে, একজন নারীবাদী সংগঠক হিসেবে আমি সংহতি প্রকাশ করতে এসেছি। কারণ আজ যৌনকর্মী বলে রাস্তায় ধরে ধরে পেটাচ্ছে কেউ, কাল পেটাবে ওড়না নেই বলে, হিজাব নেই বলে, কিংবা অন্য কোনো কারণে। পেশা, পরিচয়, পছন্দ নির্বিশেষে মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক নারীর জন্য নিরাপত্তা এবং মর্যাদার দাবি নিয়ে আমি এই সংবাদ সম্মেলনে এসেছি।


প্রশ্ন ৩: যৌনকর্মীরা কেন গার্মেন্টসের চাকরি করার কথা ভাবছেন না? কিংবা অন্য কোনো পেশায় কেন যাচ্ছেন না?


উত্তর: একজন যৌনকর্মী অন্য পেশায় যাবেন কি না সেই সিদ্ধান্ত তার। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনায় এটুকু বলতে পারি যে যৌনপেশা থেকে অন্য পেশায় যাওয়া সহজ নয়। সামাজিক, আর্থিক এবং শিক্ষাগত অবস্থান থেকে অধিকাংশ যৌনকর্মী অতিশয় প্রান্তিক মানুষ। প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কোনো যৌনকর্মী যদি বিকল্প পেশায় নিযুক্ত হনও তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সুযোগ কম। তবে মূল কথা হলো বিকল্প পেশা খুঁজতে আজকে যৌনকর্মীরা এখানে আসেননি। আপনাদের প্রশ্ন আপনাদের মানসিক সংস্কার থেকে আসছে। আমি মনে করি আপনাদের উচিত নিজেদের মানসিক সীমাবদ্ধতা থেকে বের হয়ে পেশাদার প্রশ্ন করা।  


প্রশ্ন ৪: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্টের এই দেশে একজন নারীর কি যৌনকর্মী হওয়া উচিত?


উত্তর: আমি অনুরোধ করব ধর্মকে এই আলোচনার বাইরে রাখতে। আমি বিশ্বাস করি ধর্ম যার যার, অধিকার সবার। কে কীভাবে ধর্ম পালন করবেন সেটা তার ব্যাপার। আপনারা যৌনকর্মী আপাদেরকে জিজ্ঞেস করলে জানবেন উনারা নিজেদের মতো করে ধর্ম পালন করেন। আমি মনে করি তাদের জীবিকার ঔচিত্য তাদের স্রষ্টা এবং নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়ার ব্যাপার। মানুষের যেমন আইন নিজের হাতে তুলে নেবার অধিকার নেই, তেমনি ধর্ম কিংবা অন্য কোনো নৈতিক মাপকাঠিতে মানুষকে বিচার করার অধিকারও আমাদের নেই। 


প্রশ্ন ৫: রাস্তায় একজন ভাসমান যৌনকর্মীকে দেখলে আপনার কেমন লাগে? আপনার কি মনে হয় না এতে পরিবেশ নষ্ট হয়?


উত্তর: রাস্তায় কে যৌনকর্মী আমি সেটা দেখে বুঝতে পারি না। রাস্তায় অনেক রকমের মানুষ থাকেন। কে যৌনকর্মী, কে ভিখারি, কে ফেরিওয়ালা, কে চা বিক্রেতা, কে অফিসগামী সেটা আমি আলাদা করে খেয়াল করি না। সবাইকেই মানুষ হিসেবে দেখি। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কারণ হতে পারেন বলে আমি মনে করি না।


প্রশ্ন ৬: আপনি কি মনে করেন ভাসমান যৌনকর্মী থাকা উচিত? নাকি কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় তাদের কাজ করা উচিত?


উত্তর: আমি মনে করি নির্ধারিত জায়গায় যৌনপেশা পরিচালনা করাটা সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও নিরাপদ। এবং এর জন্যই যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকার ও দায়দায়িত্ব নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই নির্ধারিত নিরাপদ জায়গা না থাকলে, পেশাগত স্বীকৃতি ও বাধ্যবাধকতা না থাকলে, ব্রথেল উচ্ছেদ করে দিলে যৌনকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে এবং তারা ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে আরো বিপন্ন হয়ে পড়েন। 


প্রশ্ন ৭: আজকে যৌনকর্মীরা বললেন যে তারা যৌনকর্মের মাধ্যমে সমাজকে রক্ষা করছেন, এ ব্যাপারে আপনার মত কী? আপনি কি মনে করেন যৌনকর্মীরা না থাকলে সমাজে ধর্ষণ বেড়ে যেত? 


উত্তর: এই বক্তব্যের সপক্ষে আমার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। বাংলাদেশের যৌনকর্ম নিয়ে অনেক গবেষণা এবং বই রয়েছে। আপনারা সেগুলো পড়ে দেখতে পারেন এবং যৌনকর্মীদের সাথে সরাসরি আলাপ করে দেখতে পারেন। তবে আমি আমার অনুমান থেকে বলতে পারি যে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের যে অনিয়ন্ত্রিত যৌন আকাঙ্ক্ষা তার প্রধান চাপ আমাদের যৌনকর্মীরা বহন করেন। আমাদের সমাজে নারীদেরকে যৌন অবদমন শেখানো হয়। নারীদের উপর স্থান ও সময়ের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। পুরুষের জন্য এসব বিধিনিষের নেই। আমাদের সেই অর্থে কোনো যৌনশিক্ষাও দেওয়া হয় না। ফলে পুরুষের অবাধ এবং অনিরাপদ যৌনাচারের যথেষ্ট সুযোগ এখানে রয়েছে, যার ভুক্তভোগী আমাদের যৌনকর্মীরা হয়ে থাকেন। তারা তাদের সেই যাতনার অভিজ্ঞতা থেকে, ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে যেই বক্তব্য তুলে ধরেন তার ব্যাখ্যা তাদের কাছ থেকেই শোনা সমীচীন মনে করি আমি।   



প্রশ্ন ৮: অনেকে বলেন যে অনেকসময় যৌনকর্মীরা নাকি বেশি টাকা আদায়ের জন্য মারধোর করেন, গালিগালাজ করেন, মোবাইল, টাকা ইত্যাদি ছিনিয়ে রাখেন, এ ব্যাপারে আপনার মত কী? 


উত্তর: এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতা বা মতামত নেই। তবে আমি মনে করি এটি একটি গুরুতর অভিযোগ যা এই সংবাদ সম্মেলনে তুলে এনে মূল আলাপ থেকে সরে যাওয়া উচিত নয়।



প্রশ্ন ৯: আপনি কেন যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে কথা বলছেন? এমন একটা পেশা কি থাকা উচিত? 


উত্তর: প্রশ্নটা ঔচিত্যের না। মানব ইতিহাসের শুরু থেকে যৌনপেশা ছিলো, আছে, থাকবে। আড়াল করে, অবদমিত করে এই পেশাকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। যা থাকবে তাকে ভালোভাবে রাখাই যুক্তিযুক্ত। তাই আমি যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার ও পেশাগত স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পক্ষে। বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা যখন সহিংসতার শিকার হন তখন পুলিশি সহায়তা চাইতে পারেন না। অনেকসময় চিকিৎসকরাও তাদেরকে চিকিৎসা সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানান। যৌনকর্মীদের সন্তানদের অনেকসময় স্কুলে নিতে চায় না। অথচ যেসব পুরুষ এই যৌনকর্মীদের কাছ থেকে সেবা নেন তাদেরকে কেউ প্রশ্ন করেন না, সেবাগ্রহীরা পুরুষদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান না। আশা করি যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে যৌনকর্মীরা মানবিক সেবালাভের অবকাশ পাবেন, যৌনকর্মীদের সন্তানেরা সম্মানজনক জীবন পাবেন, যৌনকর্মীদের সেবাগ্রহীতাদের দায়বদ্ধতা বাড়বে, এবং বাংলাদেশে সার্বিক যৌনস্বাস্থ্যের পরিবেশ আরো নিরাপদ হবে।


প্রশ্ন ১০: আপনি কি যৌনপেশাকে প্রমোট করছেন?


উত্তর: আমি ব্যক্তির চয়েজকে প্রমোট করছি। আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে নিজের ইচ্ছায় পেশা নির্বাচনের, নিজের ইচ্ছায় জীবনযাপনের। কেউ যদি যৌনকর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে চান আমি তার ইচ্ছাকে সম্মান করার পক্ষে। সেই সঙ্গে তার নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে তার পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হলে আমি দাঁড়াব। তার পেশা আমার মাথাব্যথা নয়। 


প্রশ্ন ১১: আপনার পরিবারের কোনো পুরুষ যদি যৌনকর্মীর কাছ থেকে সেবা নেন, আপনি তাকে কী বলবেন?


উত্তর: এটি একটি হাইপোথেটিক্যাল প্রশ্ন। আমি হাইপোথেটিক্যালিই বলছি। আমার পরিবারের কোনো পুরুষ বা আমার কোনো পুরুষ বন্ধু যদি যৌনকর্মীর কাছ থেকে সেবা নেন, আমি তাকে বলব সবার আগে যৌনকর্মী নারীটিকে যেন তিনি মানুষ হিসেবে নিজের সমান মর্যাদা দেন। দ্বিতীয়ত, যৌনকর্মীর সঙ্গে কিংবা অন্য যেকারো সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য অন্যপক্ষের সম্মতি তথা কনসেন্ট যেন নিশ্চিত করেন তিনি। তৃতীয়ত, আমি তাকে বলব সেফ সেক্সের কথা। একাধিক ব্যক্তির সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হলে যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই যথাযথ প্রোটেকশন এবং পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যাপারে আমি আমার পরিচিত পুরুষকে সচেতন থাকতে বলব। 



প্রশ্ন ১২: যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কী শিখবে?


উত্তর: যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে সেখানে কিছু পেশাগত বাধ্যবাধকতা থাকবে। ফলে যৌন অধিকার ও দায়িত্বশীল যৌন আচরণ নিয়ে কথা বলার, এবং শেখার পরিসর বাড়বে। তাই আশা করি যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যৌন সম্মতি ও নিরাপদ যৌনতা সম্পর্কে শিখবে। সর্বোপরি তারা মানুষকে তার যৌনাঙ্গের ব্যবহার দিয়ে বিচার না করে তার চিন্তা ও কর্ম দিয়ে সম্মান করতে শিখবে।



প্রশ্ন ১৩: নারীর প্রতি যেই নির্যাতন হয় তা দূর করতে বাংলাদেশে কী করা উচিত? নারীশিক্ষা বাড়ালে কি নির্যাতন কমবে বলে আপনার মনে হয়?


উত্তর: নারী শিক্ষা কিন্তু অনেক বেড়েছে আমাদের। আমাদের নারী নির্যাতনবিরোধী আইনও বেশ শক্ত। এই আইনের সঠিক প্রয়োগ দরকার। নারী শিক্ষার পাশাপাশি দরকার পুরুষের শিক্ষা বাড়ানো এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনা। আমাদের নারীশিক্ষা যেমন বাড়ছে, ধর্ষণ আর যৌন হয়রানিও তো পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। নারীবিদ্বেষী অপরাধগুলো মূলত পুরুষই করছে। কারণ পুরুষ শিক্ষিত, সাহসী নারীকে গ্রহন করতে পারছে না। নারীর প্রত্যাখ্যান, নারীর নেতৃত্ব পুরুষ মেনে নিতে পারছে না। তাই আমি মনে করি নারীর প্রতি নির্যাতন দূর করতে এখন পুরুষকে সচেতন করা, পুরুষের দায়বদ্ধতা বাড়ানো জরুরি।


আমি নেহাতই একজন সংগঠক। আমাকেই যখন যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এতসব প্রশ্ন এবং নৈতিক বিচারের মুখে পড়তে হয়েছে, সেখানে একজন যৌনকর্মী কত প্রশ্ন এবং আক্রমণের মুখে পড়েন তা অনুমেয়। যৌনকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে শ্যামলীতে আক্রান্ত একজন নারী গর্ভবতী ছিলেন এবং একজন যৌনকর্মীর সন্তান এ ঘটনায় আতংকগ্রস্ত হয়ে আত্মহননের চেষ্টা করেছেন। যৌনকর্মীদের উপর এহেন আক্রমণ এবং তার ফলে যৌনকর্মীদের পরবর্তী বিপন্নতায় জনমানসে আমি যতহানি সহানুভূতি সৃষ্টি হতে দেখেছি তারচেয়ে বেশি দেখেছি করুণা এবং তিরস্কার। মাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিবিধ আলোচনা ও মন্তব্য দেখে আমার মনে হয়েছে একজন যৌনকর্মীর সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করা বাংলাদেশের রক্ষণশীল, মধ্যবিত্ত জনপদের জন্য বেশ কঠিন। সংবাদ সম্মেলনে আগত সাংবাদিকদের অনেকেই ভুলে গেছিলেন যে কারো করুণা চাইতে কিংবা পুনর্বাসনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যৌনকর্মীরা সংবাদসম্মেলনের আয়োজন করেননি। তারা সাংবাদিকদের ডেকেছিলেন তাদের নিরাপত্তার আরজি সরকারের কাছে পৌঁছানোর জন্য। এক ঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনের সিংহভাগ জুড়ে যৌনকর্মের যৌক্তিকতা, বিকল্প পেশার সম্ভাবনা, এবং যৌনকর্মীদের অপরাধপ্রবণতার সম্ভাবনা নিয়ে নানান ধরনের মোরাল পুলিসিংয়ের জবার দিতে হয়েছে উপস্থিত অধিকার কর্মীদেরকে। এই প্রশ্ন, এই নৈতিক বিচার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যে দেশে যৌনতা তথা সেক্স শব্দটি প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতেই মানুষ সংকুচিত হয়ে যায়, যে দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় যৌনশিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রবল বাধার মুখে পড়তে হয়, যে দেশে ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রথমে তার চরিত্র ও পোশাক দিয়ে ব্যবচ্ছেদ করা হয়, যে দেশে নারীর যোনীর ব্যবহার দিয়েই তার চরিত্র নির্ধারিত হয়, সে দেশের তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাদের মর্যাদার ভিত টলে যায় যৌনপেশার প্রশ্নে। একটি পেশাগত সম্মেলনে অপরিণত, অপেশাদার প্রশ্ন উত্থাপনের প্রবণতাকে আমি সেই মানসিক ধাক্কার প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখি। আশা করি এই প্রশ্নগুলো নিয়ে তারা আরো ভাববেন এবং আসন্ন আলোচনার বিভিন্ন পরিসরে ধীরে ধীরে সুচিন্তিত ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের মাধ্যমে মানবিক সমাধানে পৌঁছাতে আমাদেরকে সহায়তা করবেন। আপনাদের কারো মনে আর কোনো প্রশ্ন থাকলে মন্তব্যে লিখে দিতে পারেন। সেগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করব।

তৃষিয়া নাশতারান

প্রেসিডেন্ট, অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

No comments:

Post a Comment