Pages

Sunday, August 25, 2024

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের কাছে একজন প্রত্যাখ্যাত অতিথির প্রশ্ন

গতকাল রাতে আমি জাতির উদ্দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বার্তা শুনেছি। আরো অনেকের মতো বার্তাটি আমার ভালো লেগেছে এবং সময়োপযোগী মনে হয়েছে। ড. ইউনূস কোনোরকম নাটকীয়তা এবং বাহুল্য ছাড়া ঝরঝরে ভাষায় একটি নতুন বাংলাদেশের কথা বলেছেন যেখানে আমরা সহযোদ্ধা, এক পরিবার, সবাই সমান, যেখানে কোনো ভেদাভেদ আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে পারবে না। এই কথাগুলো শুনে আমি পাঁচ দিন আগে খসরা করে রাখা আমার লেখাটি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যা বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য যৎসামান্য ত্রাণ সমন্বয়ের ব্যস্ততার কারণে স্থগিত রেখেছিলাম। লেখাটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং আবেগ থেকে উৎসারিত হলেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের জন্য এখান থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে করি আমি। এমনকিছু আমি বলার প্রয়োজন বোধ করছি যা ড. ইউনূস তার বার্তায় বলেননি, এবং খুব সম্ভবত জানেনও না। ড. ইউনূসের পাশাপাশি আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চারজন নারী উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, যারা ২০ অগাস্ট ২০২৪ (মঙ্গলবার) ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিভিন্ন নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। এই বৈঠককে কেন্দ্র করে পাওয়া অস্বচ্ছ এবং অসৌজন্য আচরণের জবাব খুঁজছি আমি। আমার লেখার ভাষায় ক্রোধ প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু আপনাদেরকে অসম্মান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি মনে করি জবাব পাওয়া আমার অধিকার। গত রাতে ড. ইউনূসের বক্তব্য শুনে আমার আস্থা জন্মেছে যে এই জবাব এখন চাওয়া যেতে পারে।


২০ অগাস্টের ওই বৈঠকে আমার থাকবার কথা ছিলো। অন্তত আমি তা-ই জানতাম। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে অতিথিদের তালিকায় নাকি আমার নাম ছিলো না। তথ্য এবং যোগাযোগের অনুপস্থিতিতে আমি সেখানে হয়রানির শিকার হয়েছি। এই হয়রানির জের ধরে অনুভূত অসম্মানের রেশ বহুদিন থাকবে বলে ধারণা করছি। আমার অভিজ্ঞতার যথাযথ ব্যাখ্যা এবং মীমাংসা আমার প্রয়োজন।


খবরে জেনেছি বৈঠক শুরু হয়েছিল পৌনে বারোটায়। আমাকে আগেরদিন বলা হয়েছিল ২০ তারিখ সকাল ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উপস্থিত হতে। হয়েছিলাম। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা যখন অতিথিদের তালিকায় আমার নাম খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাদেরকে আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম ভেতরে কথা বলতে। সেই কার্ড ভেতরে পৌঁছেছিল কি না আমি জানি না। সকাল ১১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছি। প্রথম এক ঘণ্টা তাদের সমন্বয়হীনতার সুরাহার আশায়। পরের দুই ঘণ্টা ক্রোধে। ডেকে নিয়ে করা এই অসম্মান মেনে নিয়ে ফিরে আসার কোনো কারণ আমার ছিলো না। একজন মানুষ তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করছে দেখেও কারো ভ্রূক্ষেপ দেখিনি। দেশ পুনর্গঠনে যেখানে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, যেখানে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতার কথা আমরা বারবার বলছি, সেখানে কারিগরি বিভ্রাট কিংবা প্রটোকলের দোহাই দিয়ে মানুষ আলোচনার টেবিল থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে, এটা আমি মানতে নারাজ।


আমি কে?

আমার নাম তৃষিয়া নাশতারান। আমি একজন নারীবাদী সংগঠক ও ফোরসাইট স্ট্র‍্যাটেজিস্ট। আমি প্রযুক্তি এবং মানবাধিকারকে একত্রিত করার কৌশল ডিজাইন করি,  ভবিষ্যতকে ডিকলোনাইজ করার জন্য গবেষণা ও কাজের সমন্বয় করি। লিঙ্গবৈষম্য, ডিজিটাল অধিকার এবং ইনক্লুসিভ ভবিষ্যত আমার প্রধান মাথাব্যথা। বাংলাদেশে আমার পড়ালেখা বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশলবিদ্যায়। স্নাতকোত্তর পড়ালেখা করেছি কানাডার অকাড ইউনিভার্সিটিতে স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট অ্যান্ড ইনোভেশনে। সেখানে আমার গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো বাংলাদেশের ডিজিটাল স্পেসে নারীবাদের ভবিষ্যত। গত ১৩ বছর ধরে আমি মেয়ে নেটওয়ার্ক নামে একটি নারীবাদী গ্রাসরুটস অরগানাইজিং প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করছি যা নারীদের গ্রাসরুটস সংগঠনা, দেশি উদ্যোগের প্রসার এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আসছে। বর্তমানে আমি ফেমিনিস্ট অ্যালায়েন্স অফ বাংলাদেশ (FAB) নামে একটি উন্মুক্ত বিউনিবেশবাদী, প্রগতিশীল নারীবাদী প্লাটফর্মের সমন্বয়ক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছি। কোনো ধরনের দাতা সংস্থা কিংবা রাজনৈতিক দলের সাথে আমার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের কোনো সংযোগ নেই। এ কারণে বেশিরভাগ জায়গায় আমি বিচ্ছিন্ন থাকি।


আমি কীভাবে উপদেষ্টাদের বৈঠকে আমন্ত্রিত হলাম?

গত ১৫-ই অগাস্ট (বৃহস্পতিবার) ঋতু সাত্তার আমাকে কল দেন। ঋতু সাত্তার একজন শিল্পী। উনার একটি পারফরমেন্সের সূত্রে আমাদের পরিচয়। ঋতু জানান যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নারী সংগঠকদের একটি সৌজন্য সাক্ষাত হবে। সেখানে তিনি আমার নাম মনোনয়ন করতে চান, জানতে চান আমি আগ্রহী কি না। আমি জানাই যে আমি আগ্রহী এবং আমার বেশ কিছু প্রস্তাবনার কথাও জানাই। আমি আমার নাম, পরিচয়, ফোন নাম্বার, ইমেইল আইডি ঋতু সাত্তারকে দিই। ধারণা করেছিলাম ঋতু সাত্তার কোনোভাবে উপদেষ্টাদের সঙ্গে কাজ করছেন, এবং সেই সূত্রে অতিথি তালিকা তৈরি করার এখতিয়ার উনার আছে। ব্যাপারটা যে আসলে তেমনকিছু নয় সেটা আমি বুঝতে পারি ১৯ তারিখ রাতে যখন ঋতু সাত্তার বলতে পারছিলেন না এই বৈঠকে আর কারা থাকবেন এবং আলোচনার বিষয়বস্তু কী হবে। উনার ভাষ্যমতে উনি ক্ষুব্ধ নারীসমাজ নামের জোটের মাধ্যমে ফরিদা আখতারের সঙ্গে যুক্ত। যেহেতু ঋতু সাত্তার আমার খোঁজ উনাকে দিয়েছেন, সেই সূত্রে ঋতু সাত্তারকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এর বেশিকিছু উনি জানেন না। তবে সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করি। 


ফরিদা আখতার বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিমণ্ডলে পরিচিত মুখ। তবে উনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। ক্ষুব্ধ নারীসমাজ সম্পর্কেও খুব একটা ধারণা আমার নেই। শুধু একবার তাদের একটি সমাবেশে গেছিলাম ফেসবুক পোস্ট দেখে। ফরিদা আখতার সেখানে ছিলেন কি না জানি না। এটা যে উনার উদ্যোগ আমি সেটাও জানতাম না। উনার কিংবা বৈঠকের আয়োজকদের আর কারো সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় জানা না থাকায় আমি ঋতু সাত্তারের কথামতো বৈঠকের প্রস্তুতি নিই। বৈঠকের দিন, অর্থাৎ ২০ অগাস্ট সকাল সোয়া ১০টায় ঋতু সাত্তার আমাকে কল দেন আমি বাসা থেকে যমুনার উদ্দেশে রওনা দিয়েছি কি না নিশ্চিত হতে। আমি তখন পথে। এ পর্যন্ত আমি ঘুণাক্ষরে জানতাম না কীভাবে অতিথি তালিকা তৈরি হচ্ছে, কে তৈরি করছেন এবং কারা এই তালিকায় আছেন।


আমি যমুনার প্রধান ফটকে গিয়ে পৌঁছাই ১১টা বাজার চার মিনিট আগে। আমার নাম জানতে চাওয়া হয়। নাম শুনে উপস্থিত কর্মকর্তা বলেন যে আমার নাম ওই তালিকায় নেই। আমি তালিকা দেখতে চাই। কারণ আমার নামের বানান ভুল হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তালিকায় দেখি আমার পরিচিত এবং প্রিয় অনেক নারী সংগঠক সেই তালিকায় রয়েছেন, আবার আমার থেকেও যোগ্য অনেকে সেখানে নেই।


আমি এবার ঋতু সাত্তারকে কল দিতে শুরু করি। তিনি ফোন ধরেন না। তালিকায় আমার পরিচিত যারা ছিলেন তাদের কল দিই। তারা কেউই ফোন ধরেন না। ধারণা করি হয় তাদের ফোন সাইলেন্ট কিংবা তাদের ফোন রেখে দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বরত কর্মকর্তাদেরকে আমার ভিজিটিং কার্ড দিই। বলি ভেতরে কথা বলতে। কারণ ভাবছিলাম কোথাও কোনো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। উনারা সবিনয়ে আমাকে গাড়িতে বসতে বলেন। ভেতর থেকে খোঁজ এলে তারা আমাকে জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো খোঁজ আসে না। 


বলাবাহুল্য আমার অপেক্ষা মোটেও সুখকর ছিলো না। আমি একজন আমন্ত্রিত অতিথি। যেচে পড়ে যাইনি যে তাদের দুয়ারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হবে আমাকে। সেদিন সকাল ১০টা থেকে আমার সংগঠনের দেয়ালচিত্রের কাজ শুরু হয়েছে ঢাকার অন্য এক এলাকায়। আমি সেই কাজ ফেলে নিজেকে এবং নিজের ভাবনাগুলো গুছিয়ে এনে হাজির হয়েছিলাম সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। সেখানে আমাকে দরজা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া, বসিয়ে রাখা এবং কোনো জবাবদিহিতার ধার না ধারা কোন ধরনের সৌজন্যমূলক আচরণ? আমরা তো রাজতন্ত্রের প্রজা নই যে সিংহদুয়ার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে নীরবে করজোড়ে ফিরে আসব। আমি জবাবের অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিলাম ওখানে।



ছবি: মেয়ে নেটওয়ার্কের দেয়ালচিত্র, সৌজন্যে: সাজান রানা

বৈঠকশেষে বেলা দুইটার দিকে ঋতু সাত্তার বের হন যমুনা থেকে। তার কিছুক্ষণ পরে বের হন বীথি ঘোষ, শ্যামলী শীল এবং তাসলিমা আখতার। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন আমি বৈঠকে ছিলাম না। অর্থাৎ ঋতু সাত্তার ছাড়াও আরো মানুষ জানতেন যে ওখানে আমার থাকার কথা ছিলো। উনাদের থেকে জানতে পারি যিনি অতিথিদের তালিকা তৈরি করেছেন তার নাম সীমা দাস সীমু। আমি উনাকে চিনি না। উনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কোন পদাধিকারে যুক্ত সেটাও আমি জানি না। ঋতু সাত্তার সীমা দাসকে কল দিয়ে জানতে চাইলেন কেন আমার নাম ছিলো না তালিকায়। সীমা দাস নাকি বলেছেন তালিকা কোনোভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে। উনার দেওয়া তালিকা আর উপদেষ্টার পাঠানো তালিকা কোনো একভাবে ভিন্ন হয়ে গেছে। তিনি নাকি আরো বলেছেন পরদিন, অর্থাৎ বুধবার সকালে ফরিদা আখতারের সাথে কথা বলে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে। প্রয়োজনে ফরিদা আখতারের সাথে ্নাকি আমাকে কথা বলিয়ে দেওয়া হবে। 


বুধবারে সকাল গড়িয়ে দুপুরে হলো। বেলা তিনটার দিকে সীমা দাস সীমু আমাকে কল দিলেন। তিনি মঙ্গলবার দুপুরে ঋতু সাত্তারকে যা বলেছিলেন সেগুলোই আমাকে বললেন এবং দুঃখপ্রকাশ করলেন। তিনি এ-ও বললেন যে তিনি জানেন না কীভাবে তালিকা এলোমেলো হয়ে গেছে। ফরিদা আখতারের সঙ্গে আলাপের ব্যাপারে উনি কিছু বললেন না। 


ফরিদা আখতারের সঙ্গে এখনো আমার আলাপ হয়নি। কেন উনার সঙ্গেই কথা বলতে হবে সেটাও আমি জানি না। তবে অতিথি তালিকায় ফরিদা আখতারের ভূমিকা আছে ধারণা করে ঘটনার দিনই বিকেল তিনটার দিকে ফরিদা আখতারকে ফেসবুকে একটি মেসেজ পাঠিয়েছিলাম আমি। কারণ উনার সাথে সরাসরি যোগাযোগের আর কোনো উপায় আমার জানা ছিলো না। আমার মেসেজ উনি দেখেননি এখনো। 


ঋতু সাত্তার বলেছেন ক্ষুব্ধ নারীসমাজের পরবর্তী ইভেন্টে আমি যেন যাই। ওখানে ফরিদা আখতারের সাথে কথা বলিয়ে দেবেন ঋতু সাত্তার। একজন উপদেষ্টার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য কেন আমাকে তার সংগঠনের ইভেন্টে যেতে হবে, কেন ঋতু সাত্তার আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আলোচনার টেবিলে জায়গা পেতে কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় তৈরিতে আমি আগ্রহী নই।


এখন আমি জানতে চাই -


১। অতিথিদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ এবং অগোছালো কেন? কে বা কারা তালিকা তৈরি করছেন? সেই তালিকা কাটছাঁট করছেন কে বা কারা?


২। অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব কার এবং এর দাপ্তরিক পদ্ধতি কী? ঋতু সাত্তার কেন আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে উনার সম্পর্ক কী? 


৩। একটি রাষ্ট্রীয় আলোচনা অনুষ্ঠানের অতিথি তালিকা কি ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে হতে পারে? কেন অতিথিরা কোনো দাপ্তরিক চিঠি বা ইমেইলের মাধ্যমে আমন্ত্রণ পেলেন না? (অন্যরাও চিঠি পাননি। সবাই কারো না কারো ফোনকলে গেছিলেন।)


৪। আমার নাম কেন বাদ পড়ল তালিকা থেকে? এটা কি ইচ্ছাকৃত? এখানে কি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন কেউ? এখানে স্বচ্ছতা কীভাবে নিশ্চিত করছেন আপনারা?


৫। যদি মনে হয়ে থাকে ওই বৈঠকের জন্য ঠিক মানুষ নই, সেটা আমাকে আগে থেকে কেন জানানো হয়নি এবং কেন দুঃখপ্রকাশ করা হয়নি? কেন ডেকে নিয়ে আমার সময় নষ্ট করা হলো? 


৬। আপনারা কীসের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করছেন? কীভাবে আপনারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কারা বাংলাদেশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব করবেন? 


৭। অতিথি নির্বাচনে এত গোপনীয়তা কেন? কেন আপনারা উন্মুক্ত ডাক দেননি নারী সংগঠকদের? 


৮। ড. ইউনূসের বার্তা থেকে জেনেছি উপদেষ্টার পদমর্যাদাসম্পন্ন একজন বিশেষ সহযোগীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যার দায়িত্ব হবে জাতীয় সংহতি উন্নয়ন। তিনি কে?



ধরে নিই আমি নিতান্তই অজ্ঞ এবং অপাঙক্তেয় কেউ। তাও আমার সাথে যা ঘটেছে তা কারো সাথে করার অধিকার একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কারো নেই। বিশেষ করে যখন আপনারা একটি নতুন বাংলাদেশ, একটি সার্বজনীন ভবিষ্যতের কথা বলছেন, ক্ষমতাকাঠামোকে জনমুখী করার কথা বলছেন, তখন আলোচ্য বৈঠককে কেন্দ্র করে দৃশ্যমান অনিয়ম এবং অস্বচ্ছতা আপনাদের কর্মপদ্ধতি নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন উদ্রেক করেছে। কারা প্রতিনিধি হবেন, কারা আলোচনায় থাকতে পারবেন সেই সিদ্ধান্ত কারা নিচ্ছেন? আপনাদের তৈরি করা তালিকা কি আড়ালে অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আপনাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কতটুকু?



ঘটনার পরদিন সীমা দাস সীমু ফোনে স্নেহের সুরে আমাকে বলেছিলেন, “আমরাও তো চাই ছোট মানুষরা আসুক, নতুনদের কণ্ঠ উঠে আসুক।”

আমি উনাকে সবিনয়ে বলেছি, “দিদি, আমি কখনো দেখিনি আপনাকে। আপনি সম্ভবত আমার থেকে বয়সে বড়। কিন্তু আমি ছোট মানুষ না। আমি প্রাপ্তবয়স্ক এবং দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা আছে আমার। সেই জায়গা থেকেই আমি আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চেয়েছি।”


আমি উনাকে যা বলেছি, আপনাদেরও তা-ই বলব – সমস্যাটা ব্যক্তিগত নয় এবং আপনাদের প্রতি আমার কোনো ব্যক্তিগত বিরাগ নেই। তাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনোরকম আলাপ বা দুঃখপ্রকাশে এই সমস্যার সুরাহা হবার নয়।  আমি সীমা দাস সীমুকে বলেছি উনি যেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এটা করার এখতিয়ার উনার আছে কি না, উনি এ ব্যাপারে আপনাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কি না আমি জানি না। এখন পর্যন্ত কোনো উপদেষ্টার তরফ থেকে কোনোরকম অফিশিয়াল ব্যাখ্যা বা যোগাযোগ আমি পাইনি।


খবর পড়ে জেনেছি বৈষম্য নিরসনে নারী অধিকার কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে বৈঠকে। আমি জানি না আপনারা কীভাবে কমিশন গঠন করবেন এবং সেই কমিশন কাদের নিয়ে কাজ করবে। সেই কমিশনে আমার মতোদের কতখানি প্রবেশাধিকার থাকবে তা জানতে উৎসুক আমি। বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিমণ্ডলে পা রাখার পর থেকে বহুবার বহু মুখে আমি শুনেছি পুরনোরা কতটা চান নতুনরা এগিয়ে আসুক। তারপর দেখেছি এই পুরনোদেরই কতজন পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকেন। সমস্যাটা উন্নয়নক্ষেত্রের নয়। সমস্যাটা বাংলাদেশের নেতৃত্বের সংস্কৃতির। ক্ষমতা কেউই ছাড়তে চান না। মাত্র একজন স্বৈরশাসকের পতন হলো। অন্ততপক্ষে অন্তর্বর্তীকালে একটি উন্মুক্ত জায়গা আমাদের প্রাপ্য ছিলো। এই উন্মুক্ত জায়গাটুকুর জন্য আমরা অনেকে অনেক বছর ধরে লড়ে যাচ্ছি। আরেকবার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলেন আপনারা। 


একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই যদি সমতা আর স্বচ্ছতা বজায় রাখতে না পারে, তাহলে আগামীর দলীয় রাজনীতির কী অবস্থা দাঁড়াবে, ভাবুন। বয়স, শ্রেণি, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক পরিচিতি দিয়ে তৈরি করা হায়ারার্কি আর কত? আমি তাও যথেষ্ট সুবিধাপ্রাপ্ত একজন মানুষ। আমি ইন্টারনেট ব্যবহার করে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারি, কেউ জায়গা না দিলে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে পারি। যে মানুষটি আরো প্রান্তিক, যে মানুষের প্রবেশগম্যতা সীমিত, যে মানুষটির কণ্ঠ রুদ্ধ সে কীভাবে আপনাদের সাথে যুক্ত হবে? আপনি, আপনারা, আমি, আমরা সবাই তো একই পক্ষের মানুষ। এই পক্ষে সবার ক্ষমতা সমান তো? আমি একটি ডিকলোনাইজড, ইনক্লুসিভ ভবিষ্যত চাই। আমি চাই সবার জন্য স্বাধীন বিচরণ এবং মতপ্রকাশের সহজ, স্বচ্ছ পথ তৈরি হোক। আসুন, শুরুটা হোক একজন দলছুট, ক্ষমতাহীন মানুষের ক্রোধের জবাব দেওয়ার মধ্য দিয়ে। 


ড. ইউনূস সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। আমি ধৈর্য ধরে আপনাদের জবাবের অপেক্ষায় রইলাম।


তৃষিয়া নাশতারান

২৬ অগাস্ট ২০২৪

যোগাযোগ: nashtaran@gmail.com


No comments:

Post a Comment