Pages

Monday, December 30, 2019

বিজনেস ক্লাস

প্লেনের বিজনেস ক্লাস নিয়ে আমার আগ্রহ ছিলো অনেকদিন থেকেই। মধ্যবিত্ত বাঙালি যখন সরকারি সফরে বিজনেস ক্লাস পায়, তখন কায়দা করে টিকেটের ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে দেখেছি (ছবির মতো)।

বন্ধুর মা-বাবা হজ্জে যাওয়ার সময় যে বিজনেস ক্লাসে গেছেন সেই গল্প কায়দা করে বলতে শুনেছি। বাংলাদেশের একজন সেলিব্রেটি রাঁধুনিকে বলতে শুনেছি তিনি যখন বিজনেস ক্লাস থেকে বের হচ্ছিলেন তখন ইকোনমি ক্লাসের এক যাত্রী তার ছবি তুলে কী ভীষণ 'উদ্ধত' আচরণ করেছিল। এসব দেখে আমার জানার ইচ্ছা ছিলো বিজনেস ক্লাসের বিশেষত্ব। এবার এমিরাতস এয়ারলাইনস রীতিমতো যেচে পড়ে আমাকে বিজনেস ক্লাসে তুলে দেওয়ায় সেই ইচ্ছাটা পূরণ হলো। আমার মতো যাদের এ ধরনের হাভাতে কৌতূহল আছে তারা বাকিটা পড়তে পারেন। এবার আমি সফরের প্রথম অংশ এমিরাতসের ইকোনমি ক্লাসে উড়েছি, দ্বিতীয় অংশে উড়েছি বিজনেস ক্লাসে। এই দুইয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরব।



Space:
বিজনেস ক্লাসে বসার জায়গা বড়। সামনে পিছে, ডানে বামে সবদিকেই। সিট হেলিয়ে দিলে পেছনের যাত্রীর বুকের উপর চড়াও হতে হয় না। সুইচ টিপলে পা ছড়িয়ে দেওয়ার জায়গা তৈরি হয়ে যাবে। আরামে ঘুমানো যাবে। আমি সমস্যায় পড়েছি স্ক্রিন নিয়ে। জায়গা বেশি বলে টিভি স্ক্রিন বসার জায়গা থেকে বেশ খানিকটা দূরে। শুরুতে আমার রিমোট কাজ করছিল না। ফলে টাচস্ক্রিন ছুঁয়ে ছুঁয়ে চ্যানেল বদলানোর জন্য আমাকে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পিঠ বাঁকিয়ে স্ক্রিনের কাছে যেতে হচ্ছিল। ইকোনমি ক্লাসে স্ক্রিন ছোট হলেও একদম চোখের সামনে থাকে। সেই স্ক্রিনে আমি আরামে চারটা মুভি দেখে ফেলেছিলাম আগেরবার। বিজনেস ক্লাসে একটা দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
Privacy:
বিজনেস ক্লাসের প্রাইভেসি বেশি। দুই সিটের মাঝে হালকা দেয়াল থাকে। যদিও বিজনেস ক্লাসে আমার বাম পাশে বসা বাঙালি ভাইটি পুরো পথ দেয়াল ডিঙিয়ে আমাকে আড়চোখে দেখে গেছেন এবং আমার চ্যাগায় রাখা পায়ে লাথি দিয়ে দিয়ে টয়লেটে গেছেন। তবে তিনি ইকোনমি ক্লাসে সামনের সিটে বসা ভাইটির মতো সিটে হাত রাখতে গিয়ে বারবার আমার টিভি স্ক্রিনে হানা দিতে পারেন নাই।
Hospitality:
বিজনেস ক্লাসের ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা অতিরিক্ত আন্তরিক। সিটে বসতে না বসতেই এসে জিজ্ঞেস করবে আমি কিছু খাবো কি না। ইকোনমি ক্লাসে যেখানে চেয়েও পানি পাওয়া যায় না, গলা শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেলে উঠে গিয়ে পানি আনতে হয়, সেখানে বিজনেস ক্লাসে যেচে এসে পানি টানি দিয়ে যাওয়াটা একটু বেশিই ইয়ে লাগে। একবার ধাক্কা লেগে আমার জুসসমেত গ্লাস ফেলে দিলাম মেঝেতে। ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট মিষ্টি হাসি দিয়ে এসে মুছেটুছে আরেক গ্লাস জুস রেখে গেল। আমি সরি টরি বলে অস্থির। সে মিষ্টি হেসে বললো, এটা কোনো ব্যাপার না। অথচ ইকোনমি ক্লাসে এক বাচ্চা আইলে বমি করে দিয়েছিল বলে ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট সেটা পরিষ্কার করতে করতে শক্তমুখে বলছিল, "Stay where you are. I am trying to clean it." ফ্লাইট এটেন্ডেন্টের কষ্ট দেখে সহানুভূতি হয়েছিল আমার। বিজনেস ক্লাসের ফ্লাইট এটেন্ডেন্টদের আদরযত্ন দেখে উলটা মরমে মরে গেছি।
Food:
বিজনেস ক্লাসে খাবারের মান এবং অপশন বেশি। ইকোনমি ক্লাসে প্ল্যাকেটজাত জুস দেয়। বিজনেস ক্লাসে দেয় ফ্রেশ জুস। বিজনেস ক্লাসে শ্যাম্পেইন থাকে। আরো থাকে ওয়াইন আর ককটেইলের অনেক অপশন। ইকোনমি ক্লাসে বড়জোর ওয়াইন থাকে। তাও সবখানে না। অ্যাপেটাইজার, মেইন কোর্স, ডেজার্ট সবকিছুতেই বিজনেস ক্লাসে অপশন বেশি। খাবারের সাজসজ্জাও বেশি।
Lavatory:
টয়লেট দুই ক্লাসেই এক। আমি বিজনেস ক্লাসে আরেকটু বড় টয়লেট আশা করেছিলাম।
Others:
ইকোনমি ক্লাসে খাবারের সাথে প্যাকেটজাত ওয়েট ওয়াইপ দেয় একটা করে। বিজনেস ক্লাসে ওঠার পরপরই দেয় একটা ভাপ দেওয়া ওয়েট টাওয়েল। খাবারের সাথে আসে আলাদা ন্যাপকিন। বিজনেস ক্লাসে খাবার দেওয়ার আগে ফ্লাইট এটেন্ডেন্টরা নিজ দায়িত্বে এসে টেবিল পেতে দিয়ে তাতে চাদর বিছিয়ে দেবে। ইকোনমি ক্লাসে কোনো চাদরের বালাই নাই। খাবার এলে নিজ দায়িত্বে টেবিল খুলে নিতে হবে। বিজনেস ক্লাসের হেডফোনের মান ইকোনমি ক্লাসের থেকে ভালো। বিজনেস ক্লাসের কম্বল দুই পরতের। ইকোনমি ক্লাসে এক পরতের। মজার ব্যাপার হচ্ছে ইকোনমি ক্লাসে গুডি ব্যাগ দেয়, যার ভেতরে মোজা, আইপ্যাচ, টুথব্রাশ ইত্যাদি থাকে। বিজনেস ক্লাসে এই জিনিস দেয় নাই। আমি ভেবেছিলাম আরো ভালো মানের গুডি ব্যাগ হয়ত দেবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি আবারো বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণ করতে চাইবো?
প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে ডজন তিনেক ইকোনমি ক্লাস এবং একখানা বিজনেস ক্লাসের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, নিজের পয়সায় অদূর ভবিষ্যতে বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণের সম্ভাবনা নাই। কয়েক ঘণ্টার জন্য তুলনামূলকভাবে একটু ভালো কম্বল, একটু ভালো খাবার, কয়েক ইঞ্চি বেশি জায়গা আর একটু বেশি আদরযত্নের জন্য এত টাকা খরচ করতে আমি এখনো প্রস্তুত না। বিশেষ করে টাকা দিয়ে আদরযত্ন কেনার ব্যাপারটা আমার মধ্যে অস্বস্তি জাগিয়েছে। এবার আমি ফ্রিতে বিজনেস ক্লাসে চড়ে বসেছি বটে। ফ্লাইট এটেন্ডেন্টরা তো সেটা জানত না। তারা তাদের কাজ করেছে। ইকোনমি ক্লাসে অভ্যস্ত আমি ক্লাস দিয়ে ভালো ব্যবহার পেয়ে শেখ সাদীর মতো অনুভব করেছি। এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা আপাতত নাই।

No comments:

Post a Comment