কিছুদিন আগে যখন হীরের আংটির খোঁজখবর করছিলাম, তখন কারো কারো (কিংবা হয়ত অনেকের বা সবার) মনে প্রশ্ন জেগেছিলো আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি কি না। যারা আমাকে চেনেন তারা নিশ্চয়ই জানেন বিয়ে করতে আমার হীরের প্রয়োজন হবে না। আংটি আসলে খুঁজছিলাম আমার মায়ের জন্য। এর পেছনে একটা গল্প আছে। মুখে এই গল্পটা কখনোই বলে বোঝাতে পারব না। তাই অক্ষরের আশ্রয় নিচ্ছি। ব্লগ না লিখে আম্মুকে চিঠি লেখা যেত, মেইল করা যেত। কিন্তু আমি চাই আরো অনেকে জানুক এই গল্পটা। আমি নিশ্চিত এই গল্প আমার একার নয়, আরো অনেকের।
গল্পের শুরুটা কবে? দুই যুগ আগে যখন আমার ইচ্ছেপূরণের মূল্য আমার মা দিয়েছিলো তখন? নাকি চার দশক আগে, যখন আমার কিশোরী মায়ের ইচ্ছের মৃত্যু হয়েছিলো তখন?
আম্মু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, লড়ছে। ছবিটা আব্বুর তোলা। |
আমার যখন জন্ম, আমার মায়ের বয়স তখন ২৩। জন্মের পরপর বাবার কাজের সূত্রে ইরানের এক মনোরম গ্রামে থাকতে চলে যাই আমরা। হাসপাতালের সাথে লাগোয়া আমাদের ছোট্ট বাংলোকে ঘিরে কয়েক একরের বিশাল ফলফুলের বাগানে, যেখানে প্রায় বিকেলেই আড্ডা জমত, সেখানে এক আড্ডায় এক ইরানি বালকের বাইসাইকেলে আমার প্রথম হাতেখড়ি। তখন আমার বয়স সম্ভবত পাঁচ। বাইসাইকেল চালানো যখন শিখেই গেছি, এবার তো নিজের বাইসাইকেল চাই। প্রতি মাসে বেতন নিতে দল বেঁধে বড়রা ছোটদের বগলদাবা করে হৈ হৈ করে শহরে আসত। সেবার শহরে গিয়ে বাইসাইকেল দেখা শুরু হলো।
অনেক অনেক বাইসাইকেলের ভিড়ে চোখ আটকে গেল একটা কালো-হলুদ BMX
সাইকেলে। দাম মনে নেই। তবে দাম বাড়াবাড়ি রকমের বেশি ছিলো সেটা মনে আছে।
সঙ্গে টাকা ছিলো না, নাকি খরচের খাতায় বাজেট ছিলো না সেটাও আমার মনে নেই।
শুধু মনে আছে আমার মা কিছুতেই সেই সাইকেল ফেলে ঘরে ফিরতে রাজি ছিলো না। সে
ঠিক করল তার হাতের আংটি বেচে এই সাইকেলটা সে আমাকে কিনে দেবে। এবার আমি
বেঁকে বসলাম। জানি না কেন, মায়ের প্রিয় গয়না বিক্রি করে সাইকেল কেনার
ভাবনায় প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিলো। আম্মুই বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করালো। আমাকে
কাঁদতে দেখে আম্মু বললো বড় হয়ে অমন অনেক আংটি আমি আম্মুকে কিনে দিতে পারব,
একটা আংটির জন্য নাকি এত দুঃখ পাবার কিছু নেই। তারপর পাশের এক দোকানে গিয়ে
আংটি বিক্রি করা হলো। আংটিটার চেহারা স্পষ্ট মনে আছে আমার। সোনার আংটিতে
উঁচু উঁচু নকশা করে ছোট ছোট হীরে বসানো। নকশাটা ভালো করে মনে রাখতে
হয়েছিলো। কারণ, সেদিন সেই মুহূর্তে ছোট্ট আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম
বড় হয়ে আম্মুকে অবশ্যই সেই আংটিটা কিনে দেবো।
কতটা বড় হলে তাকে ঠিক বড় হওয়া বলে জানি না। তবে যেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য আমার মাকে লড়তে হয়েছে, সেই লড়াইয়ে অনেকখানিই জিতে গেছি। এই জয় অবশ্যই আমার মায়েরও। আমার সাথে সাথে আমার সাইকেলও বদলেছে, বড় হয়েছে। ইব্রাহিমাবাদের ধুলোমাখা পথ থেকে ঢাকার রাজপথে দীর্ঘ যাত্রায় বাংলাদেশের মেয়েদের সাইকেলের গল্প অনেকদূরই এগিয়েছে। শুধু বাকি ছিলো প্রতিজ্ঞা পূরণের। এই অনিশ্চিত সময়ে আর সবকিছুর আগে শৈশবের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করাটা আমার কাছে জরুরি মনে হলো।
কতটা বড় হলে তাকে ঠিক বড় হওয়া বলে জানি না। তবে যেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার জন্য আমার মাকে লড়তে হয়েছে, সেই লড়াইয়ে অনেকখানিই জিতে গেছি। এই জয় অবশ্যই আমার মায়েরও। আমার সাথে সাথে আমার সাইকেলও বদলেছে, বড় হয়েছে। ইব্রাহিমাবাদের ধুলোমাখা পথ থেকে ঢাকার রাজপথে দীর্ঘ যাত্রায় বাংলাদেশের মেয়েদের সাইকেলের গল্প অনেকদূরই এগিয়েছে। শুধু বাকি ছিলো প্রতিজ্ঞা পূরণের। এই অনিশ্চিত সময়ে আর সবকিছুর আগে শৈশবের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করাটা আমার কাছে জরুরি মনে হলো।
গতবছর বিডিসাইক্লিস্টের বিজয় রাইডে কোনো এক অচেনা ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় তোলা ছবি |
গয়নাগাটি যে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় সে তো সেই পাঁচ বছর বয়সেই জেনেছি। বলাবাহুল্য, হীরের আংটি নিয়ে কোনোই ধারণা আমার ছিলো না। খোঁজ নিতে বসে আবিষ্কার করলাম, ঝকমকে এই পাথরের অর্থমূল্য প্রকারভেদে এক সপ্তাহের নেপাল ট্রিপ থেকে শুরু করে এক মাসের ইউরোপ ট্রিপের সমান হতে পারে। কদিনের সঞ্চয়ে কত মূল্যে অবশেষে এই আংটি কেনা হলো সেই গল্পে আর না যাই। অর্থমূল্য এখানে নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক।
অনেক ধরেবেঁধে যেই আংটিটা আম্মুকে দিয়ে পছন্দ করাতে পারলাম সেটা দেখতে সেই আংটিটার মতো না। আমি তাকে নিয়ে গেছিলাম নিজের জন্য কিছুমিছু কিনব বলে। আমি যে আসলেই 'নিজের জন্য হীরের গয়না কিনতে চাই' সেটা বিশ্বাস করাতেও কিছুটা সময় নিয়ে সামান্য কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো। সে আদৌ জানত না সেই আংটিটার নকশা মাথায় গেঁথে বসে আছি, আর সেই আংটির স্মৃতির পথ ধরে এই আংটির পথ খোঁজার শুরু। পুরনো সেই আংটির জন্য হাহাকারও তার ছিলো না। তাই আংটি পছন্দ করার বেলায় পুরনো আংটির নকশা নিয়ে আদৌ ভাবিত ছিলো না সে। তার মেয়ে তাকে ভেবে কিছু দিয়েছে এতেই সে অতি অভিভূত। তার মেয়ে হীরে কেনার যোগ্যতা অর্জন করেছে তাতে হয়ত গর্বিতও। তার আদৌ মনে নেই আমার শৈশবের প্রতিজ্ঞার কথা, যেমনটা মনে নেই সেই আংটির শূন্যস্থান পূরণ করতে নতুন হীরের আংটি কেনার কথাও। 'এতগুলো টাকা' খরচ করে আংটি কেনায় তার ঘোর আপত্তি ছিলো। দোকানে দাঁড়িয়েই অনেকক্ষণ তার সাথে দেনদরবার করতে হয়েছে, ঠিক যেমন সাইকেলের দোকানে দাঁড়িয়ে আমাকে রাজি করতে বেগ পেতে হয়েছিলো তাকে।
হীরের দোকানে দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারিনি এই আংটির জ্যোতি আম্মুর চেহারার ছেলেমানুষি খুশি আর গর্বভরা হাসির কাছে ম্লান, শৈশবের সেই প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পারা আমার কাছে অনেক বড় কিছু।
গীতি আপা একবার বলেছিলেন, "প্রতিটা মেয়েই তার মায়ের স্বপ্ন।"
আমার মায়ের অনেক স্বপ্নই আমি পূরণ করতে পারিনি। নিজের সব স্বপ্ন যে পূরণ করতে পেরেছি তাও নয়। আমি চাই প্রতিটা মেয়ে সব কাঁটাতার পেরিয়ে মানুষ হোক, আর প্রতিটা মানুষ নিজের ইচ্ছের সমান বড় হোক, স্বপ্নের মতো উজ্জ্বল হোক তার ভবিষ্যত। সাইকেলের চাকা ঘুরে হীরের আংটির এই যাত্রা আমাদের মা-মেয়ের ইচ্ছেপূরণের পথে ছোট্ট একটা মাইলফলকমাত্র।
আমার মায়ের অনেক স্বপ্নই আমি পূরণ করতে পারিনি। নিজের সব স্বপ্ন যে পূরণ করতে পেরেছি তাও নয়। আমি চাই প্রতিটা মেয়ে সব কাঁটাতার পেরিয়ে মানুষ হোক, আর প্রতিটা মানুষ নিজের ইচ্ছের সমান বড় হোক, স্বপ্নের মতো উজ্জ্বল হোক তার ভবিষ্যত। সাইকেলের চাকা ঘুরে হীরের আংটির এই যাত্রা আমাদের মা-মেয়ের ইচ্ছেপূরণের পথে ছোট্ট একটা মাইলফলকমাত্র।
আমার চোখে পানি চলে আসছে পড়ে।
ReplyDeleteঅসাধারণ তৃষিয়াপু :) তোমার মায়ের মধ্যে আমার পরিচিত সব মাকেই দেখতে পেলাম। অনেক ভালোবাসা তোমার জন্য, আর মায়ের জন্য শ্রদ্ধা, প্রণাম :)
ReplyDeleteভালোবাসা..
ReplyDeleteঅসাধারণ.......................................:)
ReplyDeleteঅসাধারন,চোখের পানি অাটকাতে হলো।ভালবাসা তোমার এবং আন্টির জন্য।
ReplyDeleteঅসাধারন,চোখের পানি অাটকাতে হলো।ভালবাসা তোমার এবং আন্টির জন্য।
ReplyDeleteচমৎকার একটা লেখা পড়লাম রে তৃষিয়া !!
ReplyDeleteচাচী কে অভিবাদন !!
আহ! এই না হলে মা, আর এই না হলে মেয়ে! আমার নিজেরও এমন অনেক অভিজ্ঞতা আছে যখন মা নিজে অনেক স্যাকরিফাইস করেছে শুধু আমার জন্য। মা রা এমনই হয়। অনেক দোয়া থাকলো আন্টির জন্য,তোমাকে ভালবাসা।
ReplyDelete░░░░░░░░░░░░▄▄░░░░░░░░░
ReplyDelete░░░░░░░░░░░█░░█░░░░░░░░
░░░░░░░░░░░█░░█░░░░░░░░
░░░░░░░░░░█░░░█░░░░░░░░
░░░░░░░░░█░░░░█░░░░░░░░
███████▄▄█░░░░░██████▄░░
▓▓▓▓▓▓█░░░░░░░░░░░░░░█░
▓▓▓▓▓▓█░░░░░░░░░░░░░░█░
▓▓▓▓▓▓█░░░░░░░░░░░░░░█░
▓▓▓▓▓▓█░░░░░░░░░░░░░░█░
▓▓▓▓▓▓█░░░░░░░░░░░░░░█░
▓▓▓▓▓▓█████░░░░░░░░░█░░
██████▀░░░░▀▀██████▀░░░░
তোমার ভালো লাগাটুকু অনুভব করার চেষ্টা করলাম। আন্টির কেমন লেগেছে জানি না। She must be overwhelmed.
ReplyDeleteI am also impressed about your memory, that you remembered it all these years.
কিছু কিছু ব্যাপার স্মৃতিতে গেঁথে যায়। এটা বোধ হয় সবার বেলায়ই হয়। আম্মুও খুব অবাক হয়েছে এই স্মৃতিটা এতদিন বয়ে চলেছি জানতে পেরে।
ReplyDeleteThis is so Beautifully written. Lots of love and hugs to the writer and salute to her Mom.
ReplyDeleteYou are an exceptional daughter.
ReplyDeleteসাবাশ আপু!
ReplyDeleteআন্টিকে অভিনন্দন,এমন মেয়ের মা হিসেবে।
অনেক ভালো লাগলো, তৃষিয়া। আসলে আবদার পূরণ করে বাচ্চার হাসিমুখ দেখতে পাওয়া বাবা-মা রা জন্যে অনেক বড় প্রাপ্তি।
ReplyDeleteYou write well! I wish you could think and work like your mom. Use your brain when you work for others. You are a public figure. Foolish girls in our country follow you. So try to set some example. Be bright and open minded! Rather than being angry, think about this comment. Tc.
ReplyDeleteThanks for your thought, Anonymous. But I pay little attention to opinions from people who 'bravely' hide themselves behind anonymous id's.
DeleteThis comment has been removed by the author.
DeleteYou always miss the main point. Nijer body-r moto matha ta o mota tomar. R mon ta o kalo. Be polite. Tomar Emil I'd dao. Identity niye hair hobo. Ami vitu noi identity niye. Meh....
ReplyDeleteI feel sad for you. Whoever you are, whatever is bothering you, I wish you win the battle with yourself. I wish you all the happiness you deserve.
Deleteসাহস থাকলে এখানেই পরিচয় দিতেন। ইমেইল আইডি চাইতেন না। ব্যাপার না। দিনশেষে বোঝাপড়াটা নিজের সাথে। আপনি নিজের চোখে নিজের সম্মান ধরে রাখলে পারলেই হলো। :)
I feel sad for you. Whoever you are, whatever is bothering you, I wish you win the battle with yourself. I wish you all the happiness you deserve.
Deleteসাহস থাকলে এখানেই পরিচয় দিতেন। ইমেইল আইডি চাইতেন না। ব্যাপার না। দিনশেষে বোঝাপড়াটা নিজের সাথে। আপনি নিজের চোখে নিজের সম্মান ধরে রাখলে পারলেই হলো। :)
Obossoi identity reveal korte pari. But korle tui amake sob group theke out kore dibi. Karon tor khomota ase r tui er age o tai korechis. Fazil meye. Khomota dekhas! Tui na thakle group gula aro valo thakto! Beyadop.
ReplyDeleteNa parle tokhon nijer sonman nijer kache bolei santona. Fazil!!!
ReplyDeleteঅসাধারন! আন্টির জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং শুভকামনা......আর তোমাকে অভিনন্দন নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে পারার জন্ন্য..
ReplyDeleteআমি নিজে ও এমন একটা প্রতিজ্ঞা নিজের মাঝে লালন করছি....বাস্তবায়ন এর অপেক্ষায় মাঝে মাঝে হতাশ লাগে....তোমার লেখা পড়ে আজকে নতুন উদ্দীপনা পেলাম...
সৃষ্টিকর্তা যেন আমাকে আমার মায়ের এমন গরব ভরা খুশি দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করেন, এটাই এখন একমাত্র কামনা...
Wish you lots of love and all the best, Sadia Tahsin!
ReplyDelete